"বাবা মায়ের ঝগড়ার কারণে সন্তানের মানসিক ক্ষতি সাধন তা আপনি জানেন কি?"

"বাবা মায়ের ঝগড়ার কারণে সন্তানের মানসিক ক্ষতি সাধন তা আপনি জানেন কি?"

একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, সন্তানের বয়স যখন মাত্র ছয় মাস তখন থেকেই সন্তানের উপর বাবা মায়ের ঝগড়ার প্রভাব পরতে শুধু করে। শুধু তাই নয়, যে সন্তানের বয়স ১৮ বছর তার উপরও বাবা মায়ের ঝগড়া যথেষ্ট পরিমাণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম।

 অনেকেই মনে করেন সন্তানকে শারীরিকভাবে আঘাত না করাই যথেষ্ট। কিন্তু এটি ভুল ধারণা। কখনো কখনো বাবা মায়ের মধ্যকার ঝগড়াও সন্তানের উপর শারীরিক নির্যাতনের মতই প্রভাব ফেলে।

 যেসব বাচ্চারা নিয়মিত এসব ঘটনার সম্মুখীন হয় তারা একদিকে যেমন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তেমনি এ ধরনের পরিস্থিতি বাবা মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্কেও বিশেষ প্রভাব ফেলে। স্বাভাবিক ভাবেই বাবা মা যখন রেগে থাকে তখন তারা সন্তানের সাথে সুন্দর সময় কাটাতে পারে না। হয়তোবা মাঝে মাঝে এই রাগের প্রভাব সন্তানের উপর পরে। এতে বাচ্চার স্ট্রেস লেভেল বেড়ে যেতে পারে এবং এর প্রভাব তার সার্বিক স্বাস্থ্যের উপর পরতে পারে।

 

☆ বাবা মায়ের ঝগড়া কখন সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় -

 সবচেয়ে সুখী দম্পতির মাঝেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়, মতের অমিল হয়। সব বিষয়েই যে দুজন মানুষের মত এক হবে তা কখনোই সম্ভব নয়। কিন্তু সমস্যাটি শুরু হয় যখন দুজন মানুষ অর্থাৎ বাবা মা তার সন্তানের সামানেই ঝগড়া করতে শুরু করে। সন্তানের কাছে তার বাবা মা সবচেয়ে আপন ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তারাই যখন তর্কে জড়িয়ে যায়, তীব্র কথা কাটাকাটি শুরু করে তখন তা অবধারিত ভাবে সন্তানকে মানসিকভাবে আঘাত করে।

 ◆ ঝগড়ার সময় বাবা মায়ের যেসব আচরণ সন্তানের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে সেগুলো হলো -

 ▪ রাগের মাথায় দাম্পত্য সঙ্গীকে বিভিন্ন বাজে অথবা আপত্তিকর নাম ধরে ডাকা।

 ▪ ডিভোর্স বা বিবাহ বিচ্ছেদের হুমকি দেওেয়া।

 ▪ সন্তানের সামনে নিজের সঙ্গীকে অপমান করা।

 ▪ যেকোনো ধরনের শারীরিক হিংস্রতা যেমন - দাম্পত্য সঙ্গীর শরীরে আঘাত করা, কোনো কিছু ছুঁড়ে ফেলা, আছাড় দেওয়া এ ধরনের কিছু করা।

 ▪ ঝগড়ার পরও শীতলতা বজায় রাখা অর্থাৎ দাম্পত্য সঙ্গী একে অপরের সাথে কথা না বলা।

 

ঝগড়া করে অভিভাবকরা হয়তো সঙ্গীর সাথে ৩-৪ দিন কথা বলা বন্ধ রেখেছেন। ভাবছেন যেহেতু চুপচাপ আছি এতে সন্তানদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। কিন্তু এক্ষেত্রে আপনার ধারণা ভুল। এতেও সন্তানের ক্ষতি হচ্ছে। তারা শিখছে কোনো সমস্যা হলে সেটি নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনা না করে বরং কথা বলা বন্ধ করে দিতে হয়। তারা মা বাবার কাছ থেকে সমস্যা সমাধান করার কোনো কৌশল সম্পর্কে জানতেও পারছে না।

 বাবা মায়ের এটি মাথায় রাখতে হবে, তারা সন্তানের কাছে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। বাবা মা যা করেন সন্তানও সেটি করার জন্য উৎসাহ পায়। বাবা কিংবা মা যখন তার সঙ্গীকে অপমান করে বা অসম্মান করে কথা বলে তখন সন্তানের কাছে বিষয়টি স্বাভাবিক বলে মনে হয়। ফলে সে নিজেও অন্য ব্যক্তিদের সাথে অসম্মান করে কথা বলতে শুরু করে।

 বাবা মায়ের মধ্যকার ঝগড়া শুধুমাত্র সন্তানকে মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে না। বিভিন্ন ভাবে সন্তানের শারীরিক ক্ষতিও সাধন করে থাকে। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, সন্তানের খাওয়া দাওয়ার অনিয়মের পিছনে বাবা মায়ের এই ঝগড়া বিশেষ ভূমিকা পালন করে। দাম্পত্য জীবনে বাবা মায়ের মাঝে একটু আধটু ঝগড়া হতেই পারে। উত্তেজিত অবস্থায় নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বাবা মাকে খেয়াল রাখতে হবে তাদের সন্তান সে ঝগড়ার কী কী শুনছে আর কী কী দেখছে। সেই ঝগড়া থেকে তারা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে।

 

পর্ব- দুই

 ☆ বাবা মায়ের ঝগড়া সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর যেসব নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে -

 

◆ বুদ্ধিবৃত্তি কমে যাওয়া :

 গবেষণায় দেখা গেছে, বাবা মা ঘন ঘন ঝগড়ায় লিপ্ত হলে সন্তানের মনোযোগ নষ্ট হয় এবং তারা তখন আর তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। গবেষণায় আরও দেখা গেছে এসব বাচ্চাদের যে কোনো সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা এবং কোনো প‍্যাটার্ন দেখে সেটি দ্রুত চিহ্নিত করার ক্ষমতা হ্রাস পেতে শুরু করে।

 যেসব পরিবারে অতিরিক্ত বেশি মাত্রায় ঝগড়া বিবাদ বিরাজ করে, সেসব পরিবারের সন্তানেরা গ্রেড বা পয়েন্ট পায়। কেউ কেউ আবার মাঝপথে পড়াশোনাও ছেড়ে দেয়।

 

◆ সম্পর্ক স্থাপনে সমস্যা সৃষ্টি :

 সন্তান যদি বাসায় অস্থির, প্রতিকূল বা নেতিবাচক পরিবেশে বেড়ে ওঠে তাহলে ভবিষ্যতে নিজের সম্পর্ক স্থায়ী করার ব‍্যাপারে তার অনেক সমস্যা ভোগ করতে হয়। সেটি প্রেমের সম্পর্ক হোক, বন্ধুত্ব হোক বা কর্মক্ষেত্রেই হোক; তারা সব জায়গায় হোঁচট খায়।

 ছোটবেলা থেকে বাবা মায়ের ঝগড়া বিবাদ দেখতে দেখতে বড় হওয়া সন্তান তার আশেপাশের মানুষগুলোর সাথেও বাজে আচরণ করার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। শুরু শুরুতে তারা নিজের ভাই বোনের সাথে বিবাদে জড়ায়। বাবা মা যেভাবে ঝগড়া করে, তারাও বাবা মাকে অনুকরণ করে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়।

 এ ধরনের সন্তানেরা প্রাপ্তবয়স্ক হবার পরও নিজের জন্য বিশ্বস্ত কাউকে বেছে নিতে পারে না। বাবা মায়ের ঝগড়া তাদেরকে কারো সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়াতে কিংবা তাদেরকে বিবাহ বন্ধনে জড়াতেও অনুৎসাহিত করতে পারে। তারা আশংকা করে প্রেমের সম্পর্কে জড়িলেই হয়তো আঘাত পেতে হবে।

 

◆ উগ্র স্বভাব :

সন্তান যদি বাবা মাকে সবসময় সব বিষয়ে ঝগড়া করতে দেখে তাহলে সন্তান ভাবে, কোনো সমস্যা সমাধান করার জন্য ঝগড়া করা একটি স্বাভাবিক ব‍্যাপার। ফলে অন‍্য কারোর সাথে কোনো সমস্যা হলে সন্তানেরা ঝগড়া করে কোনো সমাধানে পৌঁছনোর চেষ্টা করে।

এ ধরনের ভাবনা ও আচরণের কারণে সেই সন্তানের জীবনে নানা ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ছোট বয়সে তারা স্কুলে মানিয়ে নিতে প্রায়ই হিমশিম খায়। বড় হওয়ার পরও তারা কারো সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারে না।

 

◆ মাদক গ্রহণ :

যে বাড়িতে অশান্তি বিরাজ করে সে বাড়ির সন্তানের মাদক গ্রহণ করার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। বাবা মায়ের ঝগড়া থেকে সৃষ্ট মানসিক অবসাদ ভুলে থাকতে তারা মাদকের আশ্রয় নিতে পারে। তারা অ‍্যালকোহল, তামাক, ইয়াবা সহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্যে আসক্ত হয়ে যেতে পারে।

 

◆ আত্মবিশ্বাস হারানো :

বাবা মায়ের ঝগড়ার সময় সন্তান অসহায়বোধ করে থাকে। সন্তান নিজের প্রতি নিজে লজ্জা পায়, নিজেকে তার সব কিছুর জন্য অযোগ্য বলে মনে হয়। এভাবে সে মানসিকভাবে তীব্র চাপে পিষ্ট হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে তার আত্মবিশ্বাস অনেক কমে যায়। আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি থাকার কারণে পরবর্তী জীবনে তার ব‍্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনেও বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

 

◆ খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম ও শারীরিক ক্ষতি:

একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, সন্তানের খাওয়া দাওয়ার অনিয়মের পেছনে অভিভাবকদের ঝগড়া বেশ বড় ভূমিকা রাখে। এছাড়া তাদের ঝগড়ার কারণে সন্তানের বিভিন্ন শারীরিক ক্ষতিও হতে পারে। যেমন - ঘুমের সমস্যা, পেট ব‍্যাথা, মাথা ব‍্যাথা ইত্যাদি।

 

সর্বোপরি কোনো সন্তান এ ধরনের পরিবেশে বেড়ে উঠলে তাদের পুরো জীবনের উপরই এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। বাবা মায়ের ঝগড়া মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেলে সেক্ষেত্রে সন্তানের মঙ্গলের জন্য বাবা মায়ের উচিত থেরাপিস্টের শরণাপন্ন হওয়া এবং নিজেদের মানসিক চিকিৎসা করানো। এখানে একটি বিষয় স্পষ্টভাবে জানা উচিত, মানসিক চিকিৎসা নেওয়া মানেই ' পাগল ' হওয়া নয়।

আমাদের সমাজে মানসিক চিকিৎসা নিয়ে বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা আছে। মানসিক চিকিৎসাকে বাঁকা চোখে দেখার কিছু নেই। মানসিক চিকিৎসা নেওয়াতে লজ্জার কিছু নেই। বরং এটি সংসারে শান্তি বয়ে সক্ষম।