"জেনে নিন সন্তানের সামনে বাবা মায়ের ঝগড়া সামাল দেয়ার কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস "

"জেনে নিন সন্তানের সামনে বাবা মায়ের ঝগড়া সামাল দেয়ার কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস "

 সকল মানুষের মধ্যে যেসব অনুভূতি আদিকাল থেকে বিরাজমান তাদের মধ্যে অন‍্যতম হচ্ছে 'রাগ'। সেই রাগ কখনো কখনো রূপ নেয় নিরবতার, কখনো বা ঝগড়ার। বাবা মায়েরাও তো মানুষ। তাই তাদেরও মনমালিন‍্য হয়, ক্ষোভ হয়। কিন্তু সেই রাগ কী বাচ্চাদের সামনে প্রকাশ করা উচিত? বাচ্চাদের সামনেই কী স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ায় লিপ্ত হওয়া উচিত? এই প্রশ্নগুলো কিন্তু আজকের নয়। কয়েক প্রজন্ম ধরেই বাবা মায়েরা এর উত্তর খুঁজে আসছেন।

 সাধারণভাবে অনেকেই হয়তো বলবেন, ' অবশ্যই এটি উচিত নয়। বাচ্চাদের সামনে ঝগড়া করা একদমই উচিত নয়। ' কিন্তু কেউ কেউ আবার উল্টোটা মনে করেন। তাদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এই দ্বিতীয় পক্ষের ভাষ‍্য, ' মতের মিল না হওয়া, তর্ক হওয়া ইত্যাদি মানব জীবনের একটি অবিচ্ছেদ‍্য অংশ। তাই বাচ্চাদের সামনেই এসবের মিটমাট হওয়া উচিত। এতে বাচ্চারা শিখবে কীভাবে সমস্যার সমাধান করতে হয়।'

 অন্যদিকে প্রথম পক্ষের ব‍্যক্তিরা মনে করেন, বাবা মায়ের মধ্যকার ঝগড়া বা তর্ক দেখা বাচ্চাদের জন্য অত্যন্ত ভয়ংকর ও আতঙ্কের একটি বিষয়। বাবা মায়ের উচিত সন্তানের চোখের আড়ালে, বন্ধ দরজার ওপাশে যাবতীয় সমস্যার সমাধান করা।

 সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে - 'কোন পক্ষ সঠিক?' এর যথাযথ উত্তর হচ্ছে - ' দু'পক্ষই সঠিক, আবার কোনো পক্ষই সঠিক নয়। ' এখন বিষয়টি পরিষ্কার করে বলা যাক। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে দ্বন্দ্ব ছিল আছে এবং থাকবে। দ্বন্দ্বগুলোকে যদি পরিপক্ব আচরণের মাধ্যমে সমাধান করা হয়, উচ্চবাচ্য না করে সুন্দর আলোচনার মাধ্যমে দ্বন্দ্বের নিরসন করা হয় তাহলে সেটি দেখে বাচ্চারা ভালো কিছু শিখবে।

 তারা শিখতে পারবে কীভাবে এরকম পরিস্থিতি সুন্দর করে সামাল দিতে হয়। আর এই শিক্ষাটি তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। হয়তো সে পাঠ‍্যবই থেকে এই শিক্ষা কখনোই পাবে না। তাই এইসব শিক্ষা বাবা মায়ের কাছ থেকেই শিখতে হবে। বাস্তব জীবন থেকেই শিক্ষা নিতে হবে তাকে।

 কিন্তু দুঃখজনক ব‍্যাপার হচ্ছে, আমাদের অনেকেই এই ধরনের পরিস্থিতি সুস্থভাবে মোকাবেলা করতে জানি না। তাই বাচ্চাদের সামনে ঝগড়া হলে বা কোনো তর্ক শুরু হলে আমরা ইতিবাচক শিক্ষা দেওয়ার বদলে নেতিবাচক আচরণই বেশি করে থাকি।

 আমরা তর্ক করতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে যাই। স্বামী স্ত্রী একে অপরের সাথে শত্রুর মতো আচরণ করে থাকে। কোনো একটি বিষয়ে নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে আমরা উঠে পড়ে লাগি। কিন্তু আফসোস মূল সমস্যা সমাধানের দিকে কারোর নজর থাকে না।

 এধরনের ঝগড়া, তর্ক- বিতর্কগুলোই মূলত বাচ্চাদের কাছে আতঙ্কের বিষয়। এই তিক্ত ঘটনাগুলোই মূলত বাচ্চাদের কোমল মনে গাঢ় দাগ ফেলে এবং সে দাগ তাদের স্মৃতিতে আজীবন রয়ে যেতে পারে। সন্তানেরা যেন কোনোভাবে মানসিক ভাবে আঘাত না পায় সেজন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া উচিত। যেমন :

 

▪ ঝগড়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। সন্তানকে একদম জটিল খুঁটিনাটি জানানোর দরকার নেই। তবে বিষয়টি ব‍্যাখ‍্যা করে নিজেদের ভুলগুলো স্বীকার করা উচিত।

 ▪ সন্তানকে আশ্বস্ত করা উচিত এটি তেমন সিরিয়াস কিছুনা এবং ভবিষ্যতে এমন কিছু হবে না।

 ▪ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সন্তানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা। মাঝে মাঝে কোনো ঝামেলা হতে পারে, ঝগড়া হতে পারে কিন্তু তাতে তাদের ভালোবাসা কমে যায় নেই। তাদের পারিবারিক বন্ধন যথেষ্ট মজবুত সেটি সন্তানকে বোঝাতে হবে।

 আমার মতে বাবা মায়ের ঝগড়া যখন সব সীমা লঙ্ঘন করে ফেলে, ঝগড়া মারাত্মক পর্যায়ে চলে যায় তখন সন্তানের কথা চিন্তা করে সন্তানের মঙ্গলের জন‍্যই বাবা মায়ের উচিত থেরাপিস্টের শরণাপন্ন হওয়া এবং নিজেদের মানসিক চিকিৎসা করানো। এখানে একটি জিনিস মনে রাখা আবশ্যক যে মানসিক চিকিৎসা নেয়া মানেই 'পাগল' হওয়া নয়। আমাদের সমাজে মানসিক চিকিৎসা নিয়ে নানা রকমের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। শরীরের ছোটখাটো অসুখ বা রোগের জন্য যেমন চিকিৎসা নেওয়া হয় ঠিক তেমনি মানসিক অসুখের জন্য চিকিৎসা নেয়া যায়। মানসিক চিকিৎসাকে বাঁকা চোখে দেখার কিছু নেই। অথবা মানসিক চিকিৎসা নেওয়ায় লজ্জা পাবার কিছু নেই। অতিরিক্ত রাগ বা রাগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলাও এক ধরনের মানসিক অসুখ। তাই সংসার ও সন্তানের সুখের জন্য হলেও থেরাপিস্টের সহায়তা নেওয়া উচিত।

পর্ব- দুই

 তবে এখন দিন বদলেছে। মানুষ ধীরে ধীরে এইসব নিয়ে ভাবতে শিখেছে। কী করলে এই সকল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব তা নিয়ে মানুষ গবেষণা করেছে, এখনো করছে। বাচ্চাদের সামনে কীভাবে বাবা মায়ের এই ঝগড়া সামাল দেওয়া উচিত এ ব‍্যাপারে মূল্যবান কিছু পরামর্শ থাকছে আজকের এই লেখায়।

 

 ☆ শান্ত থাকুন এবং সম্মান দিন -

 বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য এটি হচ্ছে সেরা উপায়। ঝগড়া বা রাগারাগির সময় চিৎকার করবেন না, নাম ধরে টানাটানি করবেন না, দরজায় চাপড় মারবেন না, ব‍্যঙ্গ বিদ্রূপ করে কিছু বলা থেকে বিরত থাকুন, কখনো কোনো ধরনের হুমকি দিবেন না, কোনো জিনিস ছুঁড়ে মারবেন না অথবা লাথি দিবেন না। সর্বোপরি যে কোনো ধরনের উগ্রতা, হিংস্রতা ও সহিংসতা এড়িয়ে চলুন।

 আপনার যে কোনো হিংস্র আচরণ দেখে বাচ্চা ভয় পেয়ে যেতে পারে। ভেতরে ভেতরে চুপসে যাবে। তাছাড়া আচরণ দেখে তারা ভাববে রাগের মাথায় সহিংসতা বা উগ্রতার বহিঃপ্রকাশ একটি স্বাভাবিক বিষয়। ফলে পরবর্তীতে বাচ্চা তার ভাই বোন বা বন্ধু বান্ধবের সাথে উত্তেজিত মূহুর্তে এরকম উগ্র আচরণ করে বসবে। যা কোনোভাবেই কাম‍্য নয়।

 আপনার স্বামী বা স্ত্রী যদি নিজের মেজাজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েও ফেলে তবুও আপনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন। শান্তভাবে নিজের বক্তব্য তুলে ধরুন, শান্তভাবে আলোচনা করুন। কিন্তু যদি আপনার মনে হয় আপনিও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব‍্যর্থ হতে পারেন তাহলে চুপ করে থাকুন। পরে মেজাজ ঠাণ্ডা হলে ধীরে সুস্থে সমস্যা নিয়ে আলোচনা করুন।

 এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি। অভিভাবকেরা যখন নিজেরা একা থাকেন তখনো উপরোক্ত পরামর্শটি মেনে চলা প্রয়োজন। কারণ অনেক বাবা মা আছেন যারা ঝগড়া শুরু করার জন্য গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। বাচ্চা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর তারা তুমুল ঝগড়ায় লিপ্ত হন। কিন্তু তারা হয়তো জানেন না বা বুঝতে পারেন না যে তাদের বাচ্চাটি ঝগড়ার আওয়াজ শুনে ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে এবং বিছানায় শুয়ে চুপচাপ বাবা মায়ের ঝগড়া শুনছে আর আতঙ্ক বা ভয়ে কাঁপছে।

 

☆ বাচ্চা যেন জানতে পারে যে সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে -

 একটি দৃশ্য কল্পনা করুন, স্বামী বা স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করছেন। খুব বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছেন। কণ্ঠ স্বর চড়া হয়ে গিয়েছে। একে অন‍্যকে দোষারোপ করছেন। তারপর হঠাৎ খেয়াল করলেন আপনার বাচ্চা সব শুনছে।

 বাচ্চার সামনে আপনি আর ঝগড়া বাড়ালেন না। আপাতত চেপে গেলেন।পরে সুযোগ বুঝে ঝগড়া করবেন ঠিক করলেন।

 কিন্তু এই যে চিৎকার করতে করতে হঠাৎ থেমে গেলেন বা হুট করে চুপ হয়ে যাবার বিষয়টি বাচ্চাকে বিব্রত করে। পরবর্তীতে বাবা মা স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করলেও বাচ্চার মনের ভেতর খচ খচ করে, বাবা মা হয়তো এখনো পরস্পরের উপর রাগ করে রয়েছে। ফলে বাচ্চা এক ধরনের সংকোচ বোধ করে এবং স্বাভাবিক হতে পারে না।

 তাই বাচ্চা যদি ঝগড়া করতে দেখে ফেলে তাহলে ঝগড়া মিটে যাওয়ার বিষয়টিও তার দেখা বা জানা প্রয়োজন। সবচেয়ে ভালো হয় যদি বাবা মা বাচ্চার সামনে একে অপরের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে সমস্যার সমাধান করেন। এতে করে বাচ্চাও সমস্যা সমাধানের ব‍্যাপারে শিক্ষা পেয়ে যাবে এবং বাবা মায়ের মধ‍্যকার দ্বন্দ্ব নিরসন হওয়ায় সে স্বস্তিবোধ করবে।

 

☆ কোন বিষয়ে তর্ক করছেন মাথায় রাখুন -

 কিছু বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে বাচ্চার সামনে আলোচনা করা বা তর্ক করা একদমই উচিত নয়, এর ফলে আপনার যতই কষ্ট হোক না কেন তারপরও এদিক থেকে বিরত থাকতে হবে। বিষয়গুলো নিম্নরূপ:

 • বাচ্চার ব‍্যাপারে স্বামী স্ত্রীর মাঝে কোনো মতের অমিল হওয়া।

 • এমন কাউকে নিয়ে কঠোর আলোচনা বা তর্ক করা যাকে বাচ্চা খুব ভালোবাসে। যেমন : দাদা, দাদু, নানা, নানু।

 • আপত্তির বা অনুপোযুক্ত কোনো আচরণ নিয়ে তর্ক করা। যেমন : ফ্লার্ট, পরকীয়া, ড্রাগস কিংবা মাতলামো।

 • প্রাপ্তবয়স্কদের বিষয়। যেমন : নিজেদের ব‍্যক্তিগত বা যৌন জীবন নিয়ে কোনো তর্ক।

 

☆ নিজেদের ঝগড়ায় বাচ্চাকে জড়াবেন না-

 স্বামী স্ত্রীর তর্কের মাঝে কখনো বাচ্চাকে টেনে আনা উচিত নয়। তাকে এটাও জিজ্ঞেস করা উচিত নয় সে কাকে সমর্থন করছে। বাচ্চার জীবনে বাবা মা দু'জনই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব‍্যক্তি। কারো পক্ষ নেয়ার কথা বললে বাচ্চা দ্বিধায় পড়ে যায়। তাই বাচ্চাকে কখনো তর্কে জড়ানো যাবে না।

 

☆ নিজেদের মধ্যে নিঃশব্দে যুদ্ধ চালাবেন না-

 শিশুরা অত্যন্ত সতর্ক ও তীক্ষ্ণ অনুভূতিসম্পন্ন হয়ে থাকে। আপনি যদি স্বামী বা স্ত্রীর সাথে কোনো মৌখিক বাকবিতণ্ডা না করে চুপচাপ থাকেন আর হাঁটতে চলতে একে অন‍্যকে এড়িয়ে যান এসব কিন্তু বাচ্চা ঠিকই বুঝতে পারে। বাচ্চা টের পায় বাবা মায়ের মাঝে কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু সেই ' কিছু একটা ' যে কী এবং কতোটা গুরুতর সেটি তারা জানে না। তাই এটি বাচ্চার উপর মানসিক চাপ ফেলে। যা কোনো অভিভাবকেরই কাম‍্য নয়।

 

বাচ্চারা অনুকরণ প্রিয় হয়। বাবা মা তাদের সামনে যা যা করে বাচ্চা ভনের অজান্তেই সেই আচরণগুলো অনুকরণ করে থাকে। তাই বাচ্চার সামনে বাবা মাকে এইসব বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে বাচ্চাদের সামনে তারা আজ যা করবে তা সেই বাচ্চার আচার, আচরণ, স্বভাব, চরিত্রের মাধ্যমে ভবিষ্যতে প্রতিফলিত হবে।